অধ্যায়-৩

59 13 0
                                    

এতগুলো বাক্য শোনার পর নিজেকে আর কন্ট্রোল মুডে রাখতে পারলাম না। ডজনখানেক কথা শুনালাম ওকে। আমার রাগ্বান্বিত চোখদুটো বেচারা নাবিলাকে পুনরায় কাঁদতে কাঁদতে বারান্দায় চলে যেতে বাধ্য করল। নাবিলাকে দেওয়া বকুনিগুলো ইতিমধ্যে বাবার কান অব্দি পৌঁছেছে। ঠিক তারপরই ঘটল বাবার আগমন।
"আবার কাঁদিয়েছিস মেয়েটাকে তাই না?"
"বাবা‚ আসলে আমি...."
কথা শেষ না করতেই বাবা বলে উঠলেন‚
"কতদিন এভাবে চলতে থাকবে? আর একদিন যদি বউমাকে বকা খেতে দেখেছি তবে তোর একদিন কি আমার একদিন! যা‚ বারান্দায় গিয়ে বউমাকে নিয়ে আয়। শান্ত কর ওকে। নাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।"
কথাগুলো শেষ করতেই বাবা বাইরে প্রস্থান করলেন। সেই সঙ্গে আমিও কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাংলা সিরিয়ালের ডায়ালগসমূহ বাবা কোথা হতে রপ্ত করেছে তা ঠিক জানা নেই। আমি কি তাহলে এতটাই অমানুষ‚ এতটাই অমাইক। এতটাই অমানবিক আমি! তিন তিনটে বছর ধরে দিনের পর দিন একটা মেয়েকে মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রেখেছি। আমার জন্য পাগল অথচ আমার বিন্দুমাত্র অনুভূতিটুকুও নেই। যাহ্ শালা‚ আমি তো ভুলেই গিয়েছি নাবিলা বারান্দায়। মেয়েটা বোধহয় কেঁদেই চলেছে এখনো। উফ্‚ ওকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। হয়তো আমার মতো হতভাগার সামান্য সহানুভূতিই ওকে থামিয়ে দেবে। যা আন্দাজ করেছিলাম বারান্দায় গিয়ে ঠিক তার উল্টোটা দেখলাম। আমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেল নাকি! আরে হুইস্কির বোতল তো রাতে শেষ করেছি‚ তবে এই পড়ন্ত বিকেলে চোখে সর্ষেফুল দেখার তো কথা না। নাবিলা সেই অনন্যসুন্দর হাসিখানা দিয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ওর দৃষ্টিসীমা এক বয়স্ক কাপলদের দিকে। উনারা পাশের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকেন তবে বেশ রোমান্টিক। তাদের রোমান্টিসিজমটা ঠিক আশির দশকের মতো না বরং একাবিংশ শতাব্দীর সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। এটা বুঝতে আমার নতুন করে বেগ পেতে হয় নি। জিমে গিয়ে বুড়ো-বুড়ির সাথে প্রায় প্রত্যেকদিনই দেখা হয়। সেই ভাঙা ট্রেডমিলেই হাঁটেন দুইজন। একেবারে বাবার মতো স্বাস্থ্যসচেতন। আমি তো জিমে যাই বাবার চাপে পড়ে। জোর করে ঠেলে পাঠিয়েছে। জিমে না গেলে আমি নাকি আবার আগের মতো ভোম্বল হয়ে যাব। সময়টা বড্ড দুষ্টু। এ দুষ্টুমির ঘা কোনো মলমে সারে না। যেমনটা মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন ঠিক তেমনই। ইংরেজিতে যাকে বলে 'ডু অর ডাই'।
"একি তুমি হাসছো কেন? একটু আগেই তো অনেক রাগারাগী করলাম। তুমি তো চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বারান্দায় এসেছিলে‚" আমি বলতে লাগলাম।
ও কিচ্ছুটি বলে না। রাতের আকাশের তারার মতো মেঘের দিকে চেয়ে রয়েছে। নাবিলার চোখগুলো ঈষৎ ফোলা। গত তিন বছরে কতই না কাঁদিয়েছি! ফুলে ফুলে চোখদুটো আরও বড় হয়ে গেছে। চোখের পাপড়িতে মাশকারা দেওয়ায় সেখান থেকে আরও উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। আমি যেন সেখানে এক অদ্ভুত রকমের মরীচিকা দেখতে পাচ্ছি। মুখটাও চোখের পানি দিয়ে ভিজে ভিজে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘমালা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। আমিও কিছুক্ষণ সেদিকে দৃষ্টি দিলাম। নাবিলা হঠাৎই বলে উঠলো‚
"আমি কি তোমার উপর অভিমান করে থাকতে পারি বলো? জানি‚ তুমি রেগেমেগে যাচ্ছেতাই বলে ফেলো। সবকিছুই মন থেকে মুছে ফেলেছি। আকাশের দিকে দেখো‚ যতই মেঘে ঢাকা থাকুক না কেন‚ বেলাশেষে কিংবা একদিন হোক আর দুইদিন পর হোক সূর্য হাসিমুখে তার আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবেই।"

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now