পর্ব ৪৯

446 20 1
                                    

রজার নাতনির দিকে চেয়ে বললেন, "এখনও তুমি ঠিকমত সিরিয়াল বানাতে পারো না ! এখনও বাপের মত !"
ম্যাডিসন বলল, "আমি যেহেতু বাবার মেয়ে তাই বাবার মত তো হবোই |"
"খুবই ভালো কথা ! তবে বাপের মত মেজাজ টা পেয়োনা সোনা আমার | তাহলে উপায় থাকবেনা !"
"কেন ?"
"কেন কি আবার ? একটাও ছেলে পাবেনা ডেট করার জন্য |"
ম্যাডিসন হেসে বলল, "ড্যাডির মত হলে আমার বন্ধুর অভাব হবে না ! ড্যাডির প্রেমে পরে যায় এখনও অনেকেই তাকে দেখলেই |"
"ওটা তোমার বাবার চেহারার জন্য কিন্তু ওকে ভালোবেসে পাশে থাকা শুধু তোমার মায়ের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে |"
"হুম | সত্যি | আচ্ছা গ্রান্ডপা আমরা তো কিছুদিনের মধ্যেই ফিরছি তাইনা ?"
"হ্যা | এক সপ্তাহেরও কম আছি আর |"
"আমার ঘরের কথা মনে পড়ছে খুব | আর ফিনিক্সকে |"
"ফিনিক্সকে ? তুমি তো ওকে পছন্দই করোনা !"
"হ্যা কিন্তু কেন যেন মনে পড়ছে ওকে |"
"সোনা ও কিন্তু খুবই ভালোবাসে তোমাকে |"
"তাই নাকি ? ওতো দেখি এড়িয়ে চলে আমাকে |"
"না | মোটেই না | ও খুব ভালোবাসে তোমাকে | ও যতটা আমাকে আর তোমার মাকে ভালোবাসে ঠিক ততটাই ও তোমাকে ভালোবাসে | জানো ও রোজ বারোটা নাগাদ লেনে আগেপিছে দৌড়াদৌড়ি করে | শুধু তোমার জন্য | তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে বা আমার সঙ্গে ফিরলে তখন ও শান্ত হয় | রাতে যখনই তুমি কখনও তোমার সহপাঠী ইয়ানের বাড়ি যাও ও কিন্তু পিছুপিছু যায় আর বাইরেই বসে থাকে | এমনকি তুমি রাতে ঘুমালে ও লনে ঘোরাঘুরি করে লনের মাঝে এমন জায়গায় বসে যেখান থেকে তোমার জানালা দেখা যায় | ও রেক্স আর হলোইনের মত অত প্রকাশ করতে পারেনা নিজেকে | কিন্তু ও খুবই ভালোবাসে আমাদেরকে |"
ম্যাডিসন হেসে বলল, "আমি অবাক হলাম আর খুশিও হলাম | আসলে কেউ আচরণে বলে আর কেউ কাজে তাইনা ?"
রজার ছেলের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, "হুম | কেউ বর্ণনার চেয়ে উদাহরনে বেশি বিশ্বাস করে |"
.
.
.
আলিজা পাশফিরে তাকিয়ে দেখল এরিক 'পুল-আপ' করছে | আলিজা হাতে হাতঘড়ি দেখতে গিয়ে দেখল নেই হাতে ঘড়ি | আলিজা উঠে বসে পাশের বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা এরিকের ঘড়িটা তুলে দেখল | প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেছে |
"ঘুম হয়েছে তো ঠিকমত ?"
এরিকের কন্ঠে ফিরে চাইল আলিজা | এরিক পুল-আপ থামিয়ে তাকে দেখছে |
আলিজা ঘুমঘুম স্বরে একটু হেসে বলল, "আমাকে ডাকোনি কেন ?"
"সুন্দরকরে ঘুমাচ্ছিলে | ডাকতে ইচ্ছা হলো না | আর ঘুমালে আরো সুন্দর লাগে তোমাকে |"
বিছানার উপর রোব রেখে দিয়েছে এরিক |
এরিক আরো পাঁচটা পুল-আপ করে থেমে যেতে আলিজা বলল, "ডোন্ট স্টপ মাই কাউন্ট | (আমাকে দেখে থামতে হবে না )"
"তোমার জন্য থামছিনা | শেষ আমার কাজ |"
"এরিক ?"
"কি ?"
"ধন্যবাদ এরিক |"
এরিক মৃদু হেসে বলল, "ক্ষিধে পেয়েছে আমার | দ্রুত ফ্রেস হয়ে নাও সুইটহার্ট |"
আলিজা সুন্দরকরে হাসল | কিছু মানুষের আমাদের জীবনে থাকাটা আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ |
.
.
আলিজা খাবার টেবিলে এসে দেখল মাহিরা তার সকালের দ্বিতীয়কাপ চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে |
আলিজা এসে বসতেই সে মিষ্টি হেসে বলল, "ননোদিনী ! ঘুম হল ?"
আলিজা লাজুকহেসে বলল, "হুম !"
"বসো | এরিক কোথায় ? এলোনা এখনও ?"
"আসছে ও |"
"উঠেছে ? নাকি এখনও স্বপ্ন দেখছে ?"
"উঠে গিয়েছে ভাবি | ইনফ্যাক্ট ও আমার আগে উঠেছে |"
মাহিরা ঠোঁট চোখ করে বলল, "ওহঃ ! আচ্ছা !"
"ধ্যাৎ !"
আলিজা হেসে রান্নাঘরে চলে গেল | ময়না পরোটা সেঁকে রেখে দিয়েছে তাদের জন্য |
আলিজা পরোটা ভাজতে গেলে ময়না দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, "আপ্নে রাহেন ! আমি দেই |"
"কেন আপা ? আমি করছি তো |"
"না আপা | আমি দেই | আপ্নে ভাইয়েক সাথ নিয়া বইসেন গা | আমি নাস্তা দিয়া আসপানি |"
"আচ্ছা |"
আলিজা আবার ডাইনিং হলে এসে পড়ল | এরিক এসে বসেছে | মাহিরার সঙ্গে কি নিয়ে যেন হেসে হেসে কথা বলছে | আলিজা এসে তাদের সাথে বসল |
এরিক আলিজার হাতের উপর হাতটা রেখে বলল, "আজকে তো খুবই সুন্দর লাগছে তোমাকে লিজ | সুইটহার্ট আজকে কি কোন স্পেশাল দিন ?"
আলিজা হেসে বলল, "আমার জানামতে তো এমন কিছুই নেই আজ |"
"আজকে আমার তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করছে |"
"অবশ্যই না এরিক | আকাশের অবস্থা দেখেছো !"
"হুম | অভিমান করে আছে | কিন্তু সত্যি ইচ্ছা করছে ঘুরতে যেতে |"
"আচ্ছা দেখা যাক |"
এরিক আলিজার হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, "অনেক ধন্যবাদ সুইটহার্ট | এখন বল আজকে ব্রেকফাস্ট কি করবো !"
মাহিরা হা হা করে হেসে বলল, "ভালোবাসার মধ্যেও খাওয়া ?"
এরিক চেয়ারে হেলে বসে বলল, "অবশ্যই মিলেডি ! খাবার জিনিসটাই এমন যে তা সবকিছুর পরিপূরক | আর ভালো খাবার হল অত্যাবশ্যক | এই যেমন আমি ভালোবেসে লিজের হাতে বিশেষ ব্রেকফাস্ট চাই | যেমন মেরাং পাই, স্ট্রবেরি টার্ট, পেনাকটা, সুফলে, স্কচ এগ, হ্যাম স্যান্ডুইচ, ক্যাসাডিলা ! এসব তো ভালোবাসায় ভরপুর | কি সত্যি না ?"
মাহিরা হাসতে লাগল |
আলিজা বলল, "বুঝলে তো এখন ভাবি ! ভালোবাসা মানে ভালোমত উদরপূর্তি |"
এরিক স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, "কি বললে আমাকে ?"
"কেন বলবো কি বললাম ?"
"আচ্ছা ভালো খাবার তো ভালোবাসারই উদাহরণ তাইনা ? এই যেমন তুমি চমৎকার রান্না করো আমার জন্য |"
"আচ্ছা ! আচ্ছা ! থামো এখন |"
ময়না নাশতা এনে রাখতে লাগল টেবিলে |
আলিজা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "আমি যাই উনাকে সাহায্য করি |"
এরিক পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিয়ে বলল, "এ খাবারটা খুবই ভালো লাগে এখন আমার | খুবই মজাদার |"
"আশ্চর্য তুমি এরিক !"
"আরে আশ্চর্যের কি হল ? তুমি যেমন ওই খুব ঝাল আর টক কি যেন একটা অদ্ভুত রাস্তার খাবার খুবই ভালোবাসো এটাও তেমনি আমার ভালো লাগল |"
"এরিক ফুচকা-চটপটি কিন্তু মোটেই অদ্ভুত খাবার না | বরং এগুলোর মত সুস্বাদু খাবার কমই আছে |"
"মেয়েদের পছন্দগুলো মেয়েদের নিজেদের মতোই অদ্ভুত !"
আলিজা আড়চোখে এরিকের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, "একেবারে সঠিক কথা |"
.
.
মাহিরা মামলার নথি পড়ছিলো তখন দরজার সামনে ম্যাডিসনকে দেখে বলল, "ম্যাডিসন ? ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? এসো ভেতরে এসো |"
ম্যাডিসন বলল, "আমি ভাবলাম তুমি খুব ব্যস্ত |"
"ব্যস্ত যে থাকিনা তা নয় সোনামনি | আমি প্রায়ই ব্যস্ত থাকি | তবে এই মাসটায় কোন ব্যস্ততা রাখছিনা | আমি এই একটা মাস শুধু আমার আর আমার নক্ষত্রের জন্য রেখেছি |"
"কি নাম বললে ?"
"নক্ষত্র |"
"প্লিজ আমি উচ্চারণ করতে পারছিনা | আমাকে এর বানানটা লিখে দেবে ?''
মাহিরা হাসিমুখে একটা ছোট পোস্ট-ইট নোট নিয়ে তাতে নামটা লিখে দিলো |
ম্যাডিসন কিছুক্ষন দেখে বলল, "নাখখাতরিয়া ! বাহ্ অদ্ভুত সুন্দর নাম | এর মানে কি ?"
"ষ্টার ( তারকা )|"
"বাহ্ ! এত সুন্দর মানে এর ? খুব সুন্দর নাম তোমার সন্তানের |"
"এটা আসলে তোমার মায়ের দেয়া নাম | আমি ওকে বললাম আমার মেয়ের জন্য একটা নাম চাই | তো ও এই নামটা বলল |"
"তুমি কিকরে জানলে তোমার মেয়ে হবে ?"
"আমার মন বলছে |"
"খুবই ভালো হবে |"
ম্যাডিসন কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, "জানো তোমাকে আমার খুবই ভালো লাগে |"
মাহিরা হেসে বলল, "তাই ? কেন ?"
"তুমি অনেকটা আমার মায়ের মত একজন মানুষ | যে শুধু নিজের নয়, অন্যকে নিয়েও নিজের মত ভাবে | তাদের ভালোমন্দ নিজের ভালোমন্দের মত দেখে | তুমি চাইলে অনেককিছুই হতে পারতে কিন্তু তোমার আপনজনদের তুমি কখনোই ফেলতে পারোনা | তুমি তাদেরকে নিজের অংশ ভাব | যেমনটা আমার মা করে |"
"এতকিছু লক্ষ করেছো আমাকে নিয়ে ! অনেক ধন্যবাদ তোমাকে |"
"ধন্যবাদ তোমাদের প্রাপ্য | আমি তোমাকে আর মাকে দেখে বুঝি যে মেয়েরা আসলে অনেক ক্ষমতাবান | তাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয় | তারা অনেক যোগ্যতা রাখে | যেমনটা তোমরা |"
"মেয়েরা কখনোই দুর্বল না সোনা আমার |" আলিজার কন্ঠ শুনে ম্যাডিসন ফিরে তাকালো |
আলিজা মেয়ের চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে দুহাতে মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, "মেয়েরা অনেক শক্তিশালী | তারা এতটা শক্তিশালী যে একটা নতুন প্রাণের জন্ম দিতে সক্ষম তারা | তাদেরকে সমাজের গতানুগতিক অসারত্ব দুর্বল করে রাখে শুধু নানান অসুবিধায় জড়িয়ে যাতে সে নিজের ক্ষমতায়, নিজের স্বরূপে না আসতে পারে |"
মাহিরা জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, "ইস ! এরিকের প্ল্যান তো গেল আলিজা |"
আলিজা ঠোঁটটিপে হেসে বলল, "হুম ভাবি | এই দুঃখে কি করে ও এখন দেখা যাক |"
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে | ম্যাডিসন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "আমি যাই বৃষ্টি দেখব |"
মাহিরা আলিজাকে চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলল, "বসো | নাকি তুমিও বৃষ্টি দেখতে বেরুবে ?"
আলিজা বসে বলল, "আরে নাহ ! এখন কি আর সেইসব খেয়ালীপনার বয়স আছে নাকি !"
"তাই নাকি ? তুমি তো দিনকে দিন আরো সুন্দর হচ্ছো !"
আলিজা হা হা করে হেসে ফেলে বলল, "তুমিও দেখছি ভাইয়ার মত কথা বলছ |"
"তোমার ভাইয়া তো মিথ্যা বলেনি | সত্যি আলিজা ! খুব সুন্দর হচ্ছো তুমি |"
"ধ্যাৎ ভাবি !"
"এজন্য এরিক এখন আরো বেশি তোমাকে চায় | ওকে দেখি আমি আর এটাই বুঝি যে ওর কি প্রকার আকর্ষণ তোমার প্রতি |"
"ভাবি ! কি অদ্ভুত কথা বলছ !"
"মোটেই অদ্ভুত না |"
"ভাবি জান ভাইয়া অনেক সুন্দর ছিল দেখতে ?"
মাহিরা মুচকি হেসে বলল, "আমি জানবোনা কেন ? তোমার ভাইটা আমার কে হয় !"
আলিজা হেসে বলল, "আমি এটা বলছিনা যে এখন সে কম সুন্দর | কিন্তু ওর ভার্সিটি লাইফের কথা বলছি | জান আমার সব বান্ধবী ওর জন্য ক্রাশ খেত !"
মাহিরা শব্দকরে হেসে বলল, "তাই ! অবশ্য অসত্য না ! ও আসলেই 'প্রিন্স চার্মিং' ক্যাটাগরির |"
"হুম | ভাবি আমি কিন্তু আমার ভাইয়ের মত এত সুন্দর ছিলাম না কখনোই | মানে ওকে আমার সঙ্গে দেখলে আমার অনেক নাকউঁচু ক্লাসমেটই পিলপিল করে এগিয়ে আসতো ওর সঙ্গে পরিচিত হতে | আর গত পরশু আমার যে বান্ধবীকে দেখলে না রিমি, রিমি রীতিমত পাগলামো করত ভাইয়ার জন্য |"
"ওই বয়সটাই তো পাগলামোর জন্য আলিজা |"
"হুম | তবে আমার ওর পরিণত চেহারাটাই ভালো লাগে সবসময় | অর্থাৎ এই সাতটা বছর |"
"কি কারন এর ?"
"তখন ও অনেক ইমম্যাচুর্ড ছিল | কিন্তু এখন ও অনেক ব্যক্তিত্ববান একজন | আরকি ভাবি জান ? ও সবসময়ই আমার সবচেয়ে কাছের আপনজন |"
মাহিরা সুন্দরকরে হেসে বলল, "সেটা অবশ্যই জানি |"
"আর আমার অভিভাবক বললে আমি যদি কাউকে বুঝি তো সেটা শুধু ও | কারন যখনই একটা পরিবারের দরকার আমার হয়েছে ওই সেই একমাত্র পরিবারটা |"
"ওর কাছে সবসময়ই তুমি আলাদা | তোমার স্থান ওর জন্য সবার চেয়ে ভিন্ন | আমি অন্তত তাই জানি |"
দুজনেই চুপচাপ |
কিছুক্ষন পর মাহিরা নীরবতা ভেঙে বলল, "কিন্তু আইলানের একটা অসন্তোষ কিন্তু সঠিক আলিজা |"
"কি ভাবি ?"
"এরিক এসে ওর একছত্র 'প্রিন্স চার্মিং' ক্রাইটেরিয়া ভেঙে দিয়েছে |"
আলিজা কৌতূহলের সাথে বলল, "কিকরে ?"
"আরে বেপরোয়া কিন্তু যত্নশীল, নিজের মনমর্জির মালিক কিন্তু অন্যের ভালোমন্দে হস্তক্ষেপ করেনা, খেয়ালি কিন্তু করিৎকর্মা, আরামপ্রিয় কিন্তু সচেতন, আত্মমগ্ন কিন্তু খুবই প্রেমময় | আর সবচেয়ে বড় কথা ওই চেহারাটা আর ওই ব্যক্তিত্ব ! খুব আশ্চর্জ্জনক কিন্তু খুবই অসাধারন |"
আলিজা মোটামুটি অবাক হয়ে বলল, "এতগুলো গুন পেলে ওর ?"
"হুম ! কেন তুমি পাওনি ?"
"আমি সেটা সবার আগেই দেখেছি | আর শুধু গুন না দোষ তো আছেই তবে গুণগুলো এমন যা ওর প্রতি আকর্ষণ আর পরে ভালোবাসা তৈরী হতে বাধ্য করেছে আমাকে |"
.
.
মনজুর ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছিলেন খাবারের জন্য | তিনি ভেবেছিলেন এদের রান্না কিছুই খাবেন না | নিজেই কিছু একটা রান্না করবেন | কিন্তু যেতে গিয়ে থেমে গেলেন একটা দৃশ্য দেখে |
এরিক মেয়ের সঙ্গে দাবা খেলছে | কি হাসাহাসি করছে দুজনে ! দাবা খেলছে আর কি যেন একটা খাবার খাচ্ছে একসাথে | চিপসের মত দেখতে খাবারটা সামনে রাখা দুটো বাটিতে ডুবিয়ে খাচ্ছে | এরিক মাঝেমাঝে মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে | মনজুরকে দেখে মেয়েটা হাসি বন্ধ করে তাকালো | এরিক কি যেন বলল তখন মেয়েটা একবার বাপের দিকে চেয়ে মুখে একটু হাসি এনে আবার মনজুরকে দেখল | মনজুর রান্নাঘরে গিয়েও কিছুই না করে ফিরে এলেন | তিনি বসারঘরে গিয়ে বসলেন | কিন্তু একটুপর আবার উঁকি দিয়ে দেখলেন | এখনও দুজনে কথা বলছে | মনজুর আড়ালে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষন আবার লক্ষ করলেন দুজনকে | হঠাৎ এরিক ফিরে তাকালো | মনজুর দ্রুত ফিরে এলেন |
বসারঘরে বসে মনজুর বাপমেয়ের হাসিহাসি চেহারাটা মানে করতে লাগলেন | আলিজা বলল মেয়েটার বয়স পনেরো বছর | কিন্তু দেখে মনে হয়না পনেরো | বাপের মত লম্বা আর বড়সড় গড়ন পেয়েছে | এজন্য গড়নে দেখতে আঠারো-বিশের মত বয়েসী মনে হয় | কিন্তু মুখের আদল শিশুসুলভ | আর কথাবার্তাও কিশোরী মেয়েদের মতোই | এরিক একটা সচেতন বাবার মতই আচরণ করে মেয়ের সাথে কিন্তু অসম্ভব ভালোবাসে মেয়েকে | মেয়েটাও খুবই সহজ স্বাভাবিক বাপের সাথে | হৈচৈ করছে, গল্প করছে, আহ্লাদ করছে আবার বাপকে ভালোও বাসে খুব | কি দারুন একটা সম্পর্ক দুজনের | মুখে যতই এটাসেটা খুঁত বলুক সে তার মাঝেমাঝে দুজনকে দেখতে ভালোই লাগে |
মনজুর আবার একবার ডাইনিং হলে গিয়ে দেখলেন এরিক মেয়ের মাথার চুলগুলো হাতদিয়ে আঁচড়ে বেণী করে দিচ্ছে | মনজুরকে দেখে এবার আর মেয়েটা মুখ শুকনো করলোনা বরং একটু হেসে কি যেন বলতে লাগল বাপকে | মনজুর চেয়ে রইলেন দুজনের দিকে নিজের অজান্তেই | এরিক মেয়ের কানে কানে কিযেন বলল, মেয়েটা মাথা নাড়ল শুধু | এরপর সে উঠে চলে গেল |
এরিক ম্যাডিসন যাবার পর ফ্রিজ থেকে একটা পানির বোতল বের করে নিয়ে একবার শীতলচোখে শুধু তাকালো মনজুরের দিকে | এরপর সে আইলানের ঘরের দিকে চলে গেল | মনজুর অবাকই হলেন | কারন এরিক তার সাথে এমন ব্যবহার কখনও করেনি | কি হল এর ?
এরিক আইলানের ঘরে এসে আইলানের আই-পড টা নিয়ে পাশের ঘরে গেল | এখন সে দৌড়াবে কিছুক্ষন | গত দুদিন দৌড়ানো হয়নি |
.
.
এরিক মেয়ের দিকে চেয়ে বলল, "কি ব্যাপার কাপকেক ? কিছু বলতে চাচ্ছো ?"
ম্যাডিসন বলল, "হ্যা ড্যাডি | তবে তুমি এখন মনেহয় শুনবেনা |"
"অবশ্যই শুনবো সুইটি ! বলো কি ?"
"আগে তোমার দৌড়ানো শেষ হোক |"
এরিক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, "হানি এখনও অনেকসময় সেটার জন্য | তুমি বলো আমি শুনছি |"
"ড্যাডি তুমি খুবই রাগ উনার উপর তাইনা ?"
এরিক নির্বিকারভাবে বলল, "হ্যা | যদি ও তোমার মায়ের বাবা না হত তো আমার হাতে মার খেত |"
"আচ্ছা তুমি নিজে এত রাগ করেছো কিন্তু আমাকে কেন কিছুই প্রতিক্রিয়া দেখতে দিচ্ছনা |"
"কারন এটা আমাদের ঝগড়া | আর তুমি একটা বাচ্চা | এখানে তাই বড়দের সমস্যায় আমি চাইনা তুমি ক্ষোভ দেখাও |"
"কিন্তু ড্যাডি আমার মাকে নিয়ে ব্যাপারটা | এজন্যই আমি দুঃখিত আর রাগান্বিত |"
"সেটাই স্বাভাবিক সোনা | তবে এখানে আমার তোমাকে বাধা দেবার আরো একটা কারন আছে | সেটা হল তোমার মা চাইবেনা কখনোই যে তুমি তার সঙ্গে অর্থাৎ তোমার মায়ের বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো |"
"কিন্তু তুমি নিজেই তো আর তার সঙ্গে কথা বলোনা |"
"না | বলি না | আর বোধহয় আর কখনও বলবোও না | কারন সে যে কাজটা করেছে তা খুবই অমানবিক | এমনকিছুর জন্য লিজ চাইল তাকে মাফ করলেও করতে পারে | কিন্তু আমি পারবোনা তাকে মাফ করতে |"
"তাহলে আমাকে কেন ভালো ব্যবহার করতে বলছো ওর সাথে ? আমারও খুব রাগ লাগছে কেননা সে আমার মায়ের সঙ্গে অন্যায় করেছে |"
"হ্যা | কিন্তু আমার আর তোমার ব্যাপারটা ভিন্ন | আমি তার মেয়ের স্বামী সেজন্য সে যদি তার মেয়েকে অপমান করে তো আমার এখানে রাগ হবার সরাসরি অধিকার আছে | কিন্তু তুমি মেয়ের মেয়ে | তাই তুমি চাইলেই রাগ হতে পারোনা | এমনকি এইব বড় হলে সেও পারতনা | কারন যদি ঝগড়াটা সরাসরি লিজের সাথেসাথে তোমার সঙ্গেও হত তো তোমার রাগ করাটা সঠিক হত | কিন্তু তা হয়নি | সেজন্যই মায়ের হয়ে তুমি দুর্ব্যবহার করোনা | আর ম্যাডি তুমি যথেস্টই বুদ্ধিমান | সে তোমাকে অনাত্মীয় মনে করে | তাই চুপ থাকবে তুমি |"
"সেটা আমিও জানি ড্যাডি যে সে আমাকে নিজেদের কেউ ভাবেনা |"
"তাতে তোমার দুঃখ পাবার কিছুই নেই | দেখছোই তো ! সে নিজের সন্তানদেরই নিজের ভাবেনা |"
"হুম |"
ম্যাডিসন হঠাৎ হেসে ফেলে বলল, "ড্যাডি সত্যিই এতে দুঃখিত হবার কিছু নেই আমার | কেননা আমার মা খুব ভালোবাসে আমাকে | আর মা একটা কথা বলেছে "অন্যকেউ কে আমাদেরকে ভালোবাসলো তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারন যতক্ষণ আমাদের কাছের মানুষগুলো আমাদেরকে ভালোবাসে ততক্ষন কারোর অবজ্ঞায় কিছুই যায় আসে না |'' তো বুঝলেই তো ড্যাডি ব্যাপারটা তুচ্ছ আমার কাছে | তুমি, মা, গ্র্যান্ড পা, এইব, ফিনিক্স, হলোইন আমাকে অনেক ভালোবাসে | সেজন্যই অন্যদের কথা গুরুত্বপূর্ণ না |"
এরিক হেসে বলল, "হুম | দেখেছো তো একটু ভেবে খতিয়ে দেখলেই অনেককিছুই সহজ হয়ে আসে | ওকে কাপকেক আমি এখন স্পিড পিক করবো | পরে আবার কথা হবে |"
"আচ্ছা ড্যাডি ! হ্যাপি রানিং |"
ম্যাডিসন চলে গেল |
.
.
মাহিরা আলিজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, "তুমি জানো তুমি যাবার পর কিছুদিন আইলান খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করে ?"
"আন্দাজ করতে পারি কিছুটা ভাবি |"
"সত্যিই | খাওয়াদাওয়া কম হয়ে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কেমন অন্যমনস্ক থাকে | আর প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বসে থাকে |"
"ওমা ! এত রীতিমত ছিটবায়ু ! কিছু বলো না তুমি?"
"কি বলব বলো ! আর বললেও লাভ নেই | কারন মাসখানেক এমনই করে | এজন্যই এবার খুবই ভাবনা হচ্ছে আমার যে এবার নাজানি ও করবেটা কি ! কারন এরকম হাসিখুশি ফুর্তি আর উচ্ছল সময় কাটিয়েছে তোমার সঙ্গে | তুমি যাবার পর সত্যিই অনেকদিন কষ্ট পাবে ও |"
আলিজা একটু মলিন হেসে বলল, "ভাবি আমি কি স্বস্তিতে থাকি ফিরে যাবার পর ? কয়েকটা দিন যে কেমন কাটে তার কোন বর্ণনার ভাষা নেই আমার | কিন্তু মেয়েদের নিয়ম এটা | সহজ স্বাভাবিকভাবে ঘরের সব সামলে যেতে হয় | কারন কাঁদলে মন হালকা হয়না তখন আমার বরং আরো যন্ত্রনা হয় |"
"আচ্ছা আলিজা এখান থেকে যাবার পর তোমার শুধুই কি আইলানের কথা মনে পড়ে ? আর কাউকে মনে পড়ে না ?"
আলিজা মাহিরের দিকে ফিরে বলল, "কি মনে হয় ?"
"আরে আমার কথা বলছিনা |"
আলিজা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "বুঝেছি কার কথা বলছ | উত্তর হল, না | তেমন একটা মনে হয়না বাবার কথা |"
"কেন আলিজা ?"
"কারন বারবার তাকে মনে পড়ার মত সম্পর্ক আর সখ্যতা আমার আর বাবার কখনোই ছিলোনা ভাবি |"
"কখনোই না ?"
"না | ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে তার সন্তানদের দূরত্ব ছিল অনেক বেশি | সে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত শুধু পড়াশোনা নিয়ে, পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে | তার ছিল শুধুই তুলনা | এর মেয়ে ফার্স্ট হয়, অমুকের ছেলে বৃত্তি পায়, অমুকের ছেলেমেয়েদের কোন কোচিং, প্রাইভেট টিউটর লাগেনা এসবই ছিল তার কথাবার্তা আমাদের সাথে | ভাইয়া আর আমি দুজনেই খুব কম প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়েছি | কারন পড়তে চাইলেই সে হাজারটা উদাহরণ আনতো | এমনকি মেট্রিক আর ইন্টারেও আমি জীববিজ্ঞান আর রসায়নের জন্য কোন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়িনি |"
"পড়তে না কেন ? আমি জানি অনার্স লেভেলে দরকার হয়না কখনোই | তবে ইন্টারমিডিয়েটে একটু হেল্প তো লাগে | এমনকি ইউকেতে থেকেও আমার লেগেছে |"
"একেবারেই পড়িনি তা সত্যি না | রসায়ন কিছুদিন পড়ে দেখলাম ম্যাডাম কিছু ছাত্রীকে আলাদা দেখেন আর সেসব মেয়েরা আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করত | এটা ম্যাডামকে বললে উনি এর কোন বিহিত করেননি | সালমা বলে একটা মেয়ে অতিরিক্ত সিরিয়াসনেস দেখাতো | একদিন সে আমাকে 'এই চুপ' বলে ধমক দেয়ায় আমি ক্ষেপে উঠি | ওর সাথে আমার তর্ক লেগে যায় | এরপর আমি পড়া ছেড়ে দেই | জীববিজ্ঞান শিক্ষক পরপর কয়েকদিন তার পছন্দের ছাত্রীদের সামনে আমাকে ও আমার দুজন বান্ধবীকে খুব অপমান করত | আমাদের প্রতি তার ভাষাই ছিল ল্যাভেন্ডিস, স্টুপিড, গাধা, আবাল এসব ! এসব উনি উনার একটা খুব পছন্দের ছাত্রী ছিল নাসরিন তার সামনে বেশি করত | একদিন আমি স্যারকে বললাম 'আপনি এসব কেন বলেন আমাদেরকে ?' এতে সে খুব ক্ষেপে গেল আর অসম্ভব দুর্ব্যবহার করল | স্যারের হয়ে স্যারের ছাত্রী আমাদের সাথে ঝগড়া করল অনেক | আমি কেঁদে ফেলেছিলাম প্রায় এই অপমানে | স্যারের কোন ভ্রুক্ষেপই হয়নি ! আমি পরদিন গেলাম আর আমাকে দেখেই নাসরিন বলল 'অসভ্যগুলা আবার আসছে |' আমি কোন কথাই তখন বললাম না | স্যার আসার পর সেও একইরকম ব্যবহার করল | স্যার পড়া শুরু করার সাথেসাথেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম 'স্যার একটা কথা ছিল |' স্যারের বদলে নাসরিন বলল, 'আশ্চর্য তোমরা ! এমুন কেন করতেসো ! তোমাদের জন্য আমরা পড়তে পারতেসি না |' আমি ওকে বললাম 'আজকে থেকে যত ইচ্ছা পড়ো |' আমি স্যারের টেবিলে যেয়ে বেতনটা রেখে বললাম, 'স্যার আপনার এ মাসের বেতনটা | আমি আর আপনার কাছে পড়বোনা |' আমি মাত্র তিনদিন পড়ে পুরো মাসের বেতন দিয়ে চলে এসেছিলাম | স্যার আমার খাতা দেখে টেস্ট পরীক্ষায় জীববিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্রে গুনে গুনে ৩৬ দিয়েছিল | এর কারন ইচ্ছামত নম্বর কেটেও সে ফেল করাতে পারেনি আমাকে | আর নাসরিন সবসময়কার মত ৮০+ !"
"ইন্টারেস্টিং ! এরপর ?"
"এরপর আর কি বোর্ড এক্সামে আমি জীববিজ্ঞানে আর অন্যান্য গুলোতে এপ্লাস পেলাম কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে আর হাইয়ার ম্যাথে এ-গ্রেড পেলাম বলে বলে আমি পরীক্ষায় এগ্রেড পেলাম | স্যার তো খুব খুশি নাসরিন এপ্লাস পেয়েছে | আর আমি পাইনি | স্যার বারবার বললেন তার ভবিষ্যৎবাণী ফলে গিয়েছে আর আমি খারাপ ছাত্রী বলেই আমার রেজাল্ট এমন হল | কিন্তু মজার ব্যাপার হল স্যারের একজন এপ্লাসও ভার্সিটির পরীক্ষায় টিকলোনা | আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পরে কলেজে দেখা করতে গিয়েছিলাম | স্যার নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি | উনি শরীয়তপুরের কোন এক কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যায় পাশ করে একটা বেসরকারি কলেজে পড়ান | এজন্যই এই হারে উনি ক্ষেপেই গেলেন কিছুটা | আমাকে সব শিক্ষকদের সামনেই বললেন 'পড়াশুনা করবা বুঝছো ! ঠিকমত পড়বা ! তুমি তো একেবারেই পড়াশুনা করোনা !' আমি স্যারকে বললাম 'স্যার আজকে নাসরিনের সাথে দেখা হল | ও পুরোনোঢাকার একটা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছে | আশ্চর্য তাইনা স্যার ! আমরা তো নিশ্চিতই ছিলাম যে ও মেডিকেলে পড়বে যেহেতু এতভালো রেজাল্ট |' একজন ম্যাডাম আমাদের এলাকাতেই থাকতেন আর তার ছেলে ভাইয়ার ডিপার্টমেন্টে পড়ত বলে তিনি জানতেন যে আমি মেডিকেলেও টিকেছিলাম | উনি জিজ্ঞাসা করলেন 'তুমি ভর্তি কেন হলেনা মেডিক্যালে ? কি সমস্যা ?' আমি বললাম 'আমার ভাইয়া বরিশালে যেতে দেবে না |' 'ওহ ! কিন্তু গেলেই হত |' 'দেবেনা ম্যাডাম | ভাইয়া একেবারেই রাজিনা |' স্যার তখনই বলল 'আরে টিকলে তো ভর্তি হবে | এটা তো ঝরে বক মরে গেসে ! মেডিক্যাল কি এত সহজ নাকি !' সেই ম্যাডাম বললেন 'ও টিকেছে স্যার ! আমার মেয়ের সাথে একসাথে পরীক্ষা দিয়েছিল | আমার মেয়ে টিকেনি ও টিকেছে | আর আমার মেয়েটা ভার্সিটিতেও পায়নি | আর ওকে দ্যাখেন ! পেয়েছোতো বটেই তাও মাইক্রোবায়োলোজিতে | আসলেই মেধা আছে |' স্যারের মুখটা ছুঁচোর মত হয়ে গেল তখনই | আসলে ভাবি সেদিনই আমি জানলাম একটা ব্যাপার তা হল ''যোগ্যতাহীন যারা তারাই যোগ্যতাসমন্ন মানুষের দিকে আঙ্গুল তোলে আর তাদেরকে বারবার বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে | নিজের হীনতাকে ঢাকতে অন্যের চমৎকারিত্বকে মানুষ ত্রুটি মনে করে |" স্যার যেমন নিজে যা পারেননি তা তার সবচেয়ে অপছন্দের ছাত্রী করেছে সেটা মানতেও তার অহমে লাগে |"
"দারুন গল্প তো ! আচ্ছা পরে ওই মেয়েগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ?"
"হ্যা | আমি যেদিন সার্টিফিকেট আনতে যাই সেদিন ওরাও গিয়েছিল | আর স্বভাবসুলভ তামশা করছিল | আমি সার্টিফিকেটটা সংগ্রহ করে ওদের সবকয়টাকে একসাথে বললাম 'এখনও ওরকমই আছো তাইনা ? তোমাদের সমস্যা হল তোমরা ধরেই নিয়েছো যা পাবার যা করবার আজই সব করা যাবে পাওয়া যাবে | একটা জিনিস তোমাদের মনে থাকেনা সেটা হল আজকের দিনটা ফুরালে সেটা গতকাল হয়ে যায় | তোমরা এত নকশা এত তামশা করতে ক্লাসে আর প্রাইভেট পড়তে গিয়ে | এমন ভাবটা করতে যেন পুরোটা জীবন ওই পড়ার উপর নির্ভর করে | কিন্তু ওই প্রাইভেট টিউটরের পড়া ছাড়াও অনেককিছুই জানার আছে আর এই কলেজের বাইরেও জীবন আছে | এই দুবছর জীবনের অংশ কিন্তু এটাই জীবন না | তোমরা সবসময় এরকম টানাপোড়ন করে পড়াপোড়া করে জীবন কাটাবে কিন্তু শেষের হিসাব তোমাদের সবসময় শুভঙ্করের ফাঁকি |" এই বলে আমি ওদের কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে আসি |"
মাহিরা হেসে বলল, "কিছু শিক্ষক হয় খুবই দারুন আবার কেউ কেউ হয় এরকম চামার |"
"সেতো একেবারেই ঠিক ভাবি | কিছু শিক্ষক জীবন গড়ে দেয় | যেমন চৌধুরী স্যার না থাকলে আমার জীবনে আমি অন্তত এই আজকের আমি হতাম না |"
"হুম | আচ্ছা আলিজা তুমি মাস্টার্স শেষ করে একবারের জন্যও দেশে এলেনা কেন ?"
"কারন নিষেধ করা হয়েছিল |"
"মানে ? কিসের নিষেধ ?"
"তখন আমি কোন চাকরিবাকরি পাইনি আর তেমন কোন অর্থসঞ্চয়ও ছিলোনা আমার | আর বিয়েও হয়নি | এজন্য বাবা দেশে ফিরতে নিষেধ করে দিয়েছিল |"
মাহিরা হতবিস্মিত হয়ে বলল, "বলো কি ?"
"যা শুনলেন |"
"এরকম........কিকরে করলেন এমনটা ?"
"বাবার তখন এই লজ্জা রাখার জায়গা ছিলোনা যে তার সাতাশবছর বয়েসী, অবিবাহিত আর সবচেয়ে বড় কথা বেকার একটা মেয়ে দেশে ফিরবে খুব সামান্য সঞ্চয় নিয়ে | এই লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছিলো |"
মাহিরার চোখে পানি চলে এলো | সে বলল, "এজন্যই কি আইলান বারবার একথা বলে যে তোমার সাথে খুব বড় নির্দয়তা করেছে উনি ? এজন্যই ?"
আলিজা কিছু বললনা আর এ নিয়ে | সে ব্রেইন কাটলেটের ব্যাটারটা বানিয়ে একপাশে রেখে বলল, "ভাবি দেখলেন তো এখন কিভাবে হবে এটা | এবার এই সিদ্ধকরা মগজগুলোকে ছোটছোট টুকরোকরে আলতোকরে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ আর অন্যান্য মসলা দিয়ে মেখে এরকম করে গোল চ্যাপ্টা চাপের আকার করে ডোতে ডুবিয়ে ধীমে আঁচে ভাজবেন বাদামি করে |"
মাহিরা বিস্মিত হয়ে আলিজাকে দেখছে | আলিজা নেড়েচেড়ে ব্রেইন কাটলেটটা তুলে একটা পিরিচে নিয়ে চামচ দিয়ে মাহিরার হাতে দিল | মাহিরা চুপচাপ প্লেটটা হাতে নিলো |
আলিজা বলল, "ভাবি এখন চলুন ঘরে যাই | বাবা বোধহয় রান্নাঘরে কিছু রান্না করবে | চলুন |"
মাহিরা কোনরকমে বলল, "কোথায় বাবা ?"
"দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষন | চলুন বের হই |"

মেঘের আলোয়Where stories live. Discover now