#14

52 7 0
                                    

পর্ব - ১৪
*
বেশ কিছুক্ষণ হলো একটানা নিলার ফোনটা বেজেই চলেছে। চোখ মুছে নিলা ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ৪ টা মিসড কল উঠে রয়েছে। রফিক ভাইয়া কল করেছিলো। সকাল ১০.৪৩ বাজে অথচ একবারও মা ডাকেনি দেখে নিলার বেশ অবাক লাগলো। উঠে হাতমুখ ধুয়ে আসতেই দেখলো মা নিলার রুমে খাবার নিয়ে ঢুকছে।
- কিরে কখন উঠেছিস মা? রাতে অমন জ্বর বাধিয়েছিলি কিভাবে?
- জ্বর? আমার? তুমি কিভাবে জানলে?
-  শোনো মেয়ের কথা - কিভাবে আর জানব! রাতে চেক করতে এসে দেখি তোর রুমের দরজা খোলা। ঢুকে কপালে হাত দিতেই দেখলাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোর। আবার ওদিকে জ্বরের ঘোরে ক্রমাগত প্রলাপ বকে যাচ্ছিলি তুই কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দ্রুত তোর বাবাকে ডেকে এনে তোর মাথায় পানি ঢাললাম, মাথা মুছিয়ে জোর করে তোকে একটু খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলাম। এইতো ভোরের দিকে একটু ঠান্ডা হয়ে ঘুমোলি। তাই তো আর ডাকিনি। কি হলো বলতো হঠাৎ করে তোর? কয়দিন পর পরই দেখছি জ্বর আসছে৷ খারাপ কিছু হলো না তো? বিকেলেও তো ঠিক ছিলো মা।
- রাতে এতকিছু হলো আমার সাথে অথচ আমি টেরও পাইনি?
- তুই কি আর হুসে ছিলি নাকি রে? আয় এদিকে আয় বোস। খাইয়ে দেই। শরীরটা বুঝি এখনও দুর্বল।
.
খেতে খেতেই নিলা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, ''এক রাতের একটা কনভার্সেশন এভাবে ওর উপর এফেক্ট করলো? ও তো ভাবতেও পারেনি এতগুলো বছর পরেও ইমরানের কথা ওর মনে এতটা এফেক্ট করে। আগেও ইমরানের সাথে ঝগড়া হলে কান্না করতে করতে জ্বর এসে যেত নিলার। কিন্তু তখন দেখা যেত পর দিনই কোনো না কোনো ভাবে দেখা করে ইমরান নিলাকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতো। আর নিলাও গলে যেত।
কিন্তু এতগুলো বছর পরেও সেই অনুভূতিগুলো কি তেমনই আছে? তারমানে সেদিন রাইসাপুর বাসায় অত বেলা করে ঘুমানোর পরেও আপু ডাকেনি কারণ সেদিনও ওর জ্বর এসেছিলো। ইমরানের বাকা কথাগুলো আজও বেশ মনের ভেতরে বিধিয়ে যায় ''
এমন সময় নিলার ফোন বেজে উঠলো। অমনি নিলার ভাবনায় ছেদ ঘটলো।
মায়ের সাথে কথায় কথায় ভুলেই গেছিলো রফিক ভাইয়াকে কল ব্যাক করার কথা। কিন্তু রফিক ভাইয়া হঠাৎ এতবার কল করছে কেন ওকে? কারো কিছু হলো না তো! রাইসাপু ঠিক আছে তো! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলটা রিসিভ করলো নিলা।
''জ্বর কমেছে তোর? ''
'' তুমি কিভাবে জানলে ভাইয়া আমার জ্বর হয়েছে?''
'' খালামনিকে কল করেছিলাম, তোকে কলে পাচ্ছিলাম না তো। খেয়েছিস তুই?''
'' হ্যাঁ ভাইয়া খেলাম মাত্রই। আচ্ছা!  তোমার গলা এমন গম্ভীর শোনাচ্ছে কেন ভাইয়া? রাইসাপু ঠিক আছে তো?''
হঠাৎ নিলার মনে পড়লো কাল রাতে ইমরানের বলা কথা। তবে কি ও ভাইয়াকে উলটোপালটা কিছু বলে দিলো?
'' সবাই ঠিক আছে। তুই কি চট করে একবার এই বাড়িতে আসতে পারবি? ''
'' এখন? কিন্তু কেনো ভাইয়া? আপু কই আপুকে দাও তো। আপুর কিছু হয়েছে নাকি?''
'' বললাম তো কিছু হয়নি। তুই আয় এখনই। তোর সাথে জরুরী কিছু কথা আছে। ফোন রাখছি।''
...
লাইন কেটে যাওয়ার পর নিলা বুঝতে পারছিলো না ওর সাথে ঠিক কি হচ্ছে। আজ রফিক ভাইয়ার আবার কি হলো? সব তো ঠিকই ছিলো। নাহ আর ভাবতে পারছে না নিলা। তার চেয়ে বরং দ্রুত ওই বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কি হয়েছে ওই বাড়িতে গেলেই পরিষ্কার হবে।
দ্রুত খাওয়া শেষ করে মা'কে বলে রাইসা - রফিকের বাড়ির দিকে রওনা দিলো নিলা।
.
রাইসা - রফিকের বাড়িতে ইমরান এবং ইমরানের মা'কে দেখে যেন অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে নিলা। ও বুঝতেই পারছে না আসলে কি হচ্ছে বা কি হতে চলেছে ওর সাথে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রুমের ভেতর দিকে। ইমরানকে দেখেই যেন মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে নিলার। এতগুলো বছর পর বিনা দোষে কয়েকবার ওকে ওভাবে অপমানিত করার পর আজ কেন ওরা এই বাড়িতে?
নিলাকে দেখেই রফিক রাইসা এগিয়ে এলো।
'' আমাকে কেন ডেকেছো ভাইয়া? আর এরা এই বাড়িতে কি করছে?''
রফিক বেশ শক্ত ও গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো,
'' নিলা বোস তুই! রাইসা, তুমিও বোসো। শোন নিলা-  আন্টিই ইমরানকে এবাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ঠিক যে ব্যাপারগুলো এতদিন আমার আড়ালে ছিলো, আজ আমি যেমন সবটা তোর কাছ থেকে জানতে চাই.... আন্টিও ওই জন্যই এখানে। ''
রাইসা - রফিক আসলে!
রফিক - তুমি থামো রাইসা। আমি বুঝতে পারছি নিলা আর ইমরানের ব্যপারটা তুমি আগে থেকেই জানো। সেটা কোনো সমস্যা না। আমি শুধু আজ জানতে চাচ্ছি। সবটা। 
শোন নিলা, আন্টি এই বাড়িতে এসেছেন তার ছেলের কষ্ট দুর করতে। আর আমরা তোকে ডেকেছি তোর মতামত শুনতে। ইমরান এসেছে তার ভুলের ক্ষমা চাইতে। শান্ত হয়ে বোস নিলা!
ইমরানের মা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিলার কাছে এসে বললেন,
''দেখো মা! আমি জানি না বছর কয়েক আগে হঠাৎই তোমাদের মাঝে কি হলো। আমি শুধু জানতেই চাই। আমি কিছুই চাপিয়ে দিতে চাইনা তোমার ওপরে মা। আমার ছেলেটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।  ওকে কি আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি শুধু সবটা জানতে চাই, কেন আজকে তোমাদের জীবনে এই পরিস্থিতি? ''

সুযোগের কথা শুনে নিলা হতবাক হয়ে গেলো। সেই ইমরান যে কিনা গতকাল রাতে ওকে যা তা বলে অপমান করতে ছাড়লো না?
'' আন্টি, রফিক ভাইয়া আমি শান্তই আছি। আচ্ছা তা কি বলছিলে তোমরা? সুযোগ, কষ্ট? 
আন্টি? আজ তাহলে আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাবো। বেশি বড় না। কিন্তু ধৈর্য ধরে শুনবেন প্লিজ। শোনার পরেও যদি মনে হয় ইমরান সুযোগ পাওয়ার যোগ্য তাহলে আমি ভেবে দেখবো।
ইমরান হঠাৎই নিলার কাছে চলে গেলো, ''দেখো নিলা... কাল রাতের ব্যাপারে আমি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে...''
নিলা বেশ শান্ত ভাবে সোফায় বসে ইমরানের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
'' আমি চাইনা আমার বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মি. ইমরান মাহমুদ কোনো কথা বলুক।''
রফিক - ইমনার তুই বোস। নিলা! তুই শুরু কর, আমরা শুনছি।

রফিকের কথা শেষ করলে নিলা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে  রইলো। যেন পুরোটা আবার নিজের মনে পড়ে যাচ্ছে। নিজের একটু একটু করে গোছানো সাঁজানো স্বপ্নটা এক নিমিষেই কিভাবে শেষ হয়ে গেছিলো। নিলা শিউরে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে বলা শুরু করলো
-
তখন আমি ক্লাস ১০ এ উঠেছি। স্কুল থেকে এসএসসি ক্যান্ডিডেটদের জন্য বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। আমি ছোটবেলা থেকে গান শিখলেও কখনো স্টেজে উঠতাম না। প্রতিযোগিতায় নাম দিলেও স্টেজে আমি গাইনি কখনো। কিন্তু সেবার আমাদের ক্লাস টিচার এসে আমাকে খুব জোর করলেন। আমিও রাজি হলাম। স্কুল লাইফ শেষ হয়ে যাচ্ছে, একবার না হয় স্টেজেই গাইলাম।
বিদায়ে সবার উদ্দেশ্যে টিচারের সিলেক্ট করে দেওয়া গান গাইলাম স্টেজে। সারাদিন অনেক মজা করলাম। বিকেলের দিকে স্কুল থেকে বের হবো অমনি ক্লাস 2 এর একটা পিচ্চু এসে আমার হাতের ভিতরে একটা চিরকুট গুজে দিয়ে দৌড়ে পালালো। ক্লান্ত থাকায় ওর পেছনে আর দৌড়তে পারলাম না।  চিরকুটটা আগ্রহ নিয়ে খুললাম। ওতে লেখা ছিলো
"আড়ালেতে বসবাস
আড়ালেই তাঁরে দেখে যাই...
গোপনে গোপনে তাঁরে আমি
ভালোবেসে যাই। ''
""
(চলবে)

হঠাৎ দেখা [ Completed✔]Where stories live. Discover now