পার্ট - ১৫

305 13 0
                                    

আর আমি যেতে যেতে ওর দিকে তাকালাম আর মনে মনে দোয়া করলাম আল্লাহ তুমি ওরে ভালো করে দাও। 
.
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারানের রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। লিফটের ব্যবহার জানি না। তাই আমি আর আব্বু সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিলাম। তখনি আব্বু বলল
...... একটু দাড়া রেনুমা। আমি একটু হাত মুখ ধুয়ে নিই।
বোঝা যাচ্ছে আব্বুর ওপর সারাদিন খুব ধকল গিয়েছিল। এখন তাই খুবই ক্লান্ত।
আমি সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। উপর থেকে খুব হৈ চৈ এর আওয়াজ আসছিল ভ্রুক্ষেপ করলাম না। কারন হাসপাতালে এরকম হৈ চৈ হয়ে থাকে। তাতে কোন ক্ষতির কারন নেই। আমি আব্বুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এদিকে আওয়াজ খুব বাড়ছিল। তারপর দেখলাম নিচ থেকে কিছু ওয়ার্ড বয় দৌড়ে ওপরে যাচ্ছে। আমার মনে হল কোনো সিরিয়াস কন্ডিশনের এর রোগি এসেছে। 
এরপরই আমার বুক ধক করে উঠল। এটা ফারান নয়তো?? 
আমি মনের কথাটা শেষ করতে পারলাম না। সেই মুহুর্তে ফারান এসে হাজির। সিড়ির উপরে দাড়িয়ে আছে আমাকে দেখে। আমি নিচে সোফায় বসে আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাশের বাথরুমে উনি ঢুকেছিলেন। আমি ফারান কে দেখে দাড়িয়ে গিয়েছিলাম। ফারানের গায়ে একটা শার্ট জড়ানো তবে বোতাম খোলা মনে হল তাড়াহুড়া করে পড়েছে। পুরা শরীর রক্তে জব জব করছে। আমার মনে হল ফারান কিছুটা দুলছে। যতটা না লাল তার শরীর, তার চেয়ে চোখ দুটো বেশি লাল হয়ে আছে। সিড়ির দিকে নামতেই একটা ওয়ার্ড বয় ফারানকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরল। ফারান কিছু বলল না। শুধু এক বার বয় টার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। ওই দৃষ্টি দেখে বয় কিছুটা ঘাবড়ে গেছে মনে হল। তারপরও সে ফারান কে চেপে ধরে রাখল আর আমি অস্পষ্ট স্বরে আব্বুকে ডাকতে লাগলাম। ফারান ওয়ার্ড বয় টাকে হেচকা টান দিয়ে ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে পারল না বয়টি। হুরহুরে সিড়ি দিয়ে পড়তে লাগল। শেষে ওয়ার্ড বয় টি গড়িয়ে আমার কাছে পায়ের কাছে এসে থামল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে ছেলেটির। আমি মুখে হাত দিয়ে ফেললাম। ছেলেটির কোন নাড়াচাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ফারানের দিকে তাকালাম। এই নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। বরঞ্চ এটা মনে হল যে ওর রাস্তায় যে আসবে তাকে সে এভাবে শেষ করে দিবে। 
ফারান আমার মুখোমুখি এসে দাড়াল। এদিকে আব্বুও বের হচ্ছেনা। আমার খুব ভয় লাগছিল। কিন্তু ফারান খুব শান্ত অথচ গম্ভীর কন্ঠে বলল
..... মোহিনী চল আমার সাথে।।
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে আব্বু কে ডাকতে লাগলাম।
ফারান এবার গর্জে উঠে বলল
..... মোহিনী শেষ বারের মত বলছি চল আমার সাথে।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। আর সাথে সাথে আব্বু বের হয়ে এলো। আর আমি আব্বুকে ঝাপটে ধরলাম। আব্বুও বেশ অবাক হয়ে বলল
...... তুমি এখানে কি করছো?? যাও এখান থেকে।
ফারান এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল
...... তুমি তাহলে আসবেনা? ঠিক আছে।
এই বলে ফারান আমাকে ধরতে যাবে তখন আব্বু বাধা দিল। বাধা পেয়ে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। আব্বু কে দু হাতে ধরে প্রচুন্ড জোরে দেয়ালে ছুড়ে মারল। আব্বুর মাথাটা সশব্দে বাড়ি খেল। আর সাথে সাথে আব্বু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রক্তে পুরো ফ্লোর ভরে যাচ্ছে। আমি চিৎকার দিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু আব্বু সাড়া দিচ্ছিল না। আর ফারান সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমার হাত ধরে টানতে লাগল। আমি কিছুতেই যাচ্ছিলাম না। অনেক মানুষ জমায়েত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভয়ে কেউ আমাদের সাহায্য করলনা। ফারান দুহাত দিয়ে আমাকে দাড় করাল। কিন্তু আমি আমার আব্বুর কাছে যেতে চাচ্ছিলাম। তাই ওকে কিল, ঘুষি যতটা সম্ভব মারছিলাম। তাতে কোনো লাভ হলনা। ফারান আমাকে এক হাতে কাধে তুলে নির্বিঘ্নে হাটতে লাগল যেন আমি কোন কাগজের পুতুল। আমি ওর পিঠে অবিরত কিল ঘুষি মারতে লাগলাম। আর আশে পাশের মানুষের কাছে সাহায্য চাইছিলাম। কিন্তু কেউ কোন সাহায্য করলনা। আমি চিৎকার করে কান্না করছিলাম আর হাত পা ছড়াচ্ছিলাম। কিন্তু ফারান ছিল নির্বিকার। সে এক মনে কাধে করে আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে লাগল। আমি ওকে অনুরোধ করতে লাগলাম। ফারান তাও শুনল না। আমার আব্বু কোন অবস্থায় আছ, বেচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানি না। শেষে হাল ছেড়ে দিলাম। কোথায় নিয়ে যাবে যাক। শুধু কান্না করতে লাগলাম।
ফারান হাসপাতালের নিচে এসে দাড়াল। ওখানে ওদের গাড়ি রয়েছে।
একটা ব্ল্যাক রংয়ের গাড়ির সামনে এসে দাড়াল। তার পর ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে আমাকে ভিতরে ছুড়ে মারল। আর আমি মাথায় বাড়ি খেলাম। ফারান ওই পাশ দিয়ে গাড়িতে ঢুকল। আমি গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। কারন লক করে দিয়ছে ফারান। আমার আর কিছু করার নেই। গাড়ির এক কোনে বসে শুধু ফুপিয়ে কান্না করছিলাম। ফারান এক মনে নির্বিকারে গাড়ি চালাচ্ছিল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা সম্পর্কে কোন ধারনা নেই। রাস্তায়ও আগে কখনো দেখি নি। কিছুক্ষন পর গাড়ি থামল। তাকিয়ে দেখলাম সামনে পুলিশ পোষ্ট। চেকিং এর জন্য থামাইছে। ফারান এক মুহুর্তের জন্য তাকাল আমার দিকে। তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছিল যে আমি যেন পুলিশের সামনে উল্টা পাল্টা কিছু না করি। করলে তা একদম ভাল হবে না। কিন্তু আমি কখনো এই সুযোগ ছাড়বোনা। আর ফারান মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। তাই সে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরল। পুলিশ টা গাড়ির কাছাকাছি আসতেই ফারান গাড়ি স্টার্ট করে দিলো। আমি গাড়ির ভেতর থেকে পুলিশ লোকটির দিকে তাকিয়ে বাচানোর জন্য চিৎকার করলাম। পুলিশটি প্রথমেে চমকে উঠলেও পরে গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। ফের আমি কিছু আর দেখতে পেলাম না। সবকিছু পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমাকে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে ফারান গাড়ি স্লো ডাউন করল। তারপর আমার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দিতে চাইলে আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। সে দাত কিড়মিড় করে কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন পাওয়া গেল। বোঝা যাচ্ছে ওরা আমাদের ফলো করছিল। অগত্য ফারান গাড়ি জোড়ে চালানো শুরু করল। এবার সে অনেক দ্রুত চালানো শুরু করল যে আমার ঘোরা শুরু হয়ে গেল। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এমনিই আমার গাড়িতে চড়লে বমি সমস্যা অাছে। আমার খুব তখন বমি আসছিল। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম
...... গাড়ি থামাও জলদি
ফারান আমার দিকে তাকালো না। আমি আবার চিৎকার করে বললাম
...... প্লিজ গাড়ি থামাও। আমার খুব বমি আসতেছে। জলদি গাড়ি থামাও
এবার অবিশ্বাস্য চোখে ফারান তাকালো আমার দিকে। আমির চেহরা দেখে সে বুঝতে পারল। আমি সত্যি না মিথ্যা বলতেছি। পিছনে পুলিশের গাড়ি দেখে বলল
...... আরেকটু অপেক্ষা কর।
...... আমি অপেক্ষা করতে পারব না। না হলে গাড়িতে করে দেব।
...... আচ্ছা আচ্ছা গাড়িতে করিও না।
ফারান কি করল বুঝতে পারলাম না। কিন্তু পেছন থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন পাওয়া যাচ্ছিল না। গাছপালা পূর্ণ জায়গায় গাড়ি থামাল। আমি দু হাত দিয়ে মুখ চেপে বসে ছিলাম। গাড়ি থামতেই দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওইটা এখোনো লক করা। লক খোলার জন্য ফারানের দিকে তাকালাম। ফারান বলল
...... কোন রকম পালানোর চেষ্টা করবেনা।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। দরজা খোলা হলে এক দৌড়ে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে একটু দূরে বমি করতে লাগলাম। ফারান আমার পিছু পিছু দৌড়ে আসল। সে আমাকে ধরে রাখল। যখন বমি করা শেষ হল তখন আমার শরীরে আর ছিটে ফোটা শক্তি রইল না দাড়াবার। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। কারন আমি উপোস ছিলাম। ফারান আমাকে ধরে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে দিতে লাগল। তারপর একটু পানি খাওয়ালো। কিন্তু আমার শরীর মানছিল না। অবশ হয়ে আসছিল। ফারান রুমাল দিয়ে মুখ মুছে কোন রকম গাড়ির সিটে বসাল। আমি সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। দু চোখে ঘুম নেমে আসল। এর পর আর কি হয়েছিল তা আমার মনে নেই।
.
(চলবে)

মোহিনীWhere stories live. Discover now