মায়াবতী মেয়েটি

1.7K 50 18
                                    

 -এই কই তুই ?
-বাইরে বের হলাম !
-বাইরে বের হয়েছিস কেন ? তোর না শরীর খারাপ ! শুয়ে থাকতে বলেছি না তোকে !
-আরে বাবা খেতে যাচ্ছি ! খিদে লেগেছে ।
-হোটেলে খাবি ?
-আর কোথায় খাবো ? এখন রান্না করতে মন চাইছে না !
-তুই আমাদের বাসায় আয় !
-কি ? ঢং করব না তো ! এখন তোদের বাসায় যাবো কেন ?
-তোকে আসতে বলছি আয় ! একটা রিক্সা নে ! ১০/১৫ মিনিটের ভিতর চলে আসবি ! এখনই আসবি !
-নীলু .....
-কোন কথা শুনতে চাই না ! তুই এখনই আসবি ! না আসলে কিন্তু খবর আছে !

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নীলু ফোন রেখে দিল ! আমি ফোন টা হাতে নিয়ে কিছু ক্ষন দারিয়ে রইলাম । কি করবো ঠিক বুঝতে পারছি না । এখন এই দুপুর বেলা নীলুদের বাসায় যাওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না । যদিও ওদের বাসাটা খুব বেশি দুরে না । রিক্সা কেন হেটে গেলেও ১৫ মিনিটের ভিতরে পৌছে যাবো কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাবো কি না ?

আবার না গেলে নীলু চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করে দিবে আবার যাবো যে সেই উপায়ও নেই । কি এক বিচিত্র কারনে নীলুর মা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না । যদিও মুখ ফুটে কিছু বলে না তবে ওনার চোখের দিকে তাকালে সেটা ভাল ভাবেই বোঝা যায় !
শেষে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম । হোটেলে খাওয়ার চেয়ে নীলুর বাসায় গিয়ে খেয়ে আসি ! হোটেলে খেতে গেলে নিজেকে বড় বেশি অভাগা লাগে !

একবার কলিংবেল বাজানোর পরপরই নীলু দরজা খুলে দিল ! মনে হচ্ছিলো যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল ! ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখ টা একটু ফোলা ফোলা । মনে হল যেন একটু আগে কোন কারনে কান্না-কাটি করেছে ।
ওর মায়ের সাথে কোন কিছু হয়েছে ?
এমন একটা সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না একেবারে ! আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-আন্টি কোথায় ?
-ঘুমুচ্ছে ।
-সত্যি ?
-হুম !
-ওনাকে বলেছিস আমি আসছি ?
এই কথা শোনার পরই দেখলাম নীলুর মুখটা একটু মলিন হয়ে গেল ! আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে আমাকে নিয়েই ওর মায়ের সাথে ওর কিছু একটা হয়েছে । আমি কেন আসছি এখন এটা নিশ্চই ওর মায়ের খুব একাটা পছন্দ হয় নাই ! কিন্তু নীলুর জেদের কাছে শেষে পরাজিত হয়ে নিজে ঘর বন্দী হয়েছে । এই মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন পাগলামী কেন করে বুঝি না !
নীলু আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-চল তোর খিদে লেগেছে । আগে খেতে দেই !
-হুম ! কি রান্না হয়েছে আজকে ?
-খুব বেশি কিছু না ! আগে জানলে ভাল কিছু রান্না করতাম !

খাবার টেবিলের আয়োজন একেবারে খারাপ না ! বিশেষ করে রুই মাছের ঝোল টা বেশ দেখা যাচ্ছে । আমি ভাত মাখাতে মাখাতে নীলুকে বললাম
-আন্টির সাথে ঝগড়া করেছিস ?
নীলু কিছু না বলে কেবল মাথা ঝাকালো !
-আমার জন্য ?
-হুম !
-কেন ?
-এমনি ! ইচ্ছা হয়েছে তাই করেছি ! তুই মুখ বন্ধ করে খা তো ! বাইরে কি ছাতার মাথা খাস কে জানে ! এমনিতেও পেট খারাপ আরও খারাপ হবে !
আমি হাসি মুখে ভাত মুখে দেই !
ভাত মুখে নিয়ে নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে আছে । আমাকে সামনে বসিয়ে এর আগেও ও যতবার খাইয়েছে ততবারই ওর চোখে এমন একটা চাপা আনন্দ দেখেছি ! অদ্ভুদ মায়া নিয়ে মেয়েটা আমার খাওয়া দেখছে !
হঠাৎ চোখে পানি চলে আসতে চাইলো । তাড়াতাড়ি করে পানি মুখে দিলাম !
নীলু ব্যস্ত হয়ে বলল
-কি হল ?
-এতো ঝাল কেন ?
-ঝাল ? কই দেখি ?
নীলু খানিকটা অবাক হয়ে আমার প্লেট থেকে মাছের কিছু অংশ মুখ নিল !
-কই ঝাল ?
-ঝাল না ? দেখ ঝালের জ্বালায় আমার চোখে পানি চলে এসেছে !
-তাই না ! ঢং ! পানি খা !
আমি আবার খাওয়া শুরু করলে নীলু বলল
-ডাল নে ! এটা ভাল হয়েছে !
-নিচ্ছি ! তুই খেয়েছিস তো ?
-আমার খাওয়া নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না ! আপনি খান !

আমি চুপ করে খেতে লাগলাম ! মাঝে মাঝে নীলু দিকে তাকিয়ে দেখি ও আবার সেই অদ্ভুদ মায়ার চোখে আমার খাওয়া দেখছে ! আমার মন টা কেন জানি ভাল হয়ে যায় !
যখন খাওয়া শেষ করলাম তখন দেখি নীলু তোয়ালে নিয়ে এসে হাজির !

ঢাকায় এসে এই জিনিস টা আমি খুব বেশি মিস করি ! আমার মতে এই পৃথিবীতে দুই প্রকার মানুষ আছে । এক, যাদের খাওয়ার সময় তাদের প্রিয় মানুষ তাদের পাশে থাকে । দুই, যাদের কে একা একা খেতে হয় । পৃথিবীতে একা একা ভাত খাওয়ার মত দুর্ভাগা লোক আর কেউ নেই !

হাত মুছতে মুছতে বললাম
-আমি এখন যাই !
নীলু চোখ কপালে তুলে বলল
-তুই বিহারীদের মত হলি কবে থেকে ?
-মানে কি ?
-মানে জানিস না ! বিহারীরা খাওয়ার পরে কোথাও আর এক মিনিট বসতে চায় না !
-আমি তো পারলে থেকেই যাই কিন্তু তোর মা.....।
-তোকে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ! তুই বসার ঘরে গিয়ে আরাম কর ! ঘরে দই আছে । নিয়ে আসছি !

আমি বসার ঘরের বসতে বসতেই নীলুর মা বেরিয়ে এল ঘর থেকে ! আমি উঠে সালাম দিলাম ! তিনি এমন একটা ভাব করলেন যেন আমাকে ঠিক দেখতে পারেন নি এবং আমার সালাম টাও শুনতে পারেন নি ! টেবিল থেকে পানি নিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে গেলেন আমার সামনে দিয়ে ! ভাগ্য ভাল নীলু সামনে ছিল না । থাকলে হয়তো আবার ওর মায়ের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতো !

নীলু আসলো আরও কিছু সময় পরে । এরই ভিতরই পরনের সেলোয়ার কামিজ বদলেছে । মুখে পানি দিয়েছে । চুল গুলো সমান করে আচড়ানো ! আবার একটু কাজলও দিয়েছে চোখে ! আমার দিকে দইয়ের বাটি দিতে দিতে বলল
-এখন কেমন লাগছে তোর ! শরীরের অবস্থা কেমন ?
-এতোক্ষন পরে জানতে চাইলি ?
-আসলে তখন মন মেজাজ ভাল ছিল না তাই জানতে চাই নি !
আমি বাটি হাতে নিতে নিতে বললাম
-এই ঝামেলাটা টা না করলেও পারতি ! কি হত আমি বাইরে খেলে ! কত বেলাই তো খাই তাই না ?

এই কথা বলেই মনে হল ঠিক হল না ! নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর কাজল দেওয়া চোখে ততক্ষনে পানি জমতে শুরু করেছে । আমি ওকে থামানোর চেষ্টা করলাম না । এই মেয়েটা অকারন কাদে যখন তখন । আমি বাইরে খাই এই কথার কান্নার কি হল ?
কিছু না ! আমি এভাবেই আছি এই শহরে ! এখানে সেখানে খেয়েই এই ইট কাঠের শহরে বেঁচে আছি । আমার মত একজন কে নিয়ে এটো চিন্তা করার কি আছে ?
আমি বললাম
-খাবি একটু ?
-না ! তুই খা ! খেয়ে বিদায় হ !
-নে একটু !
বলে চামচটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম ! ও মুখ বাড়িয়ে সেটা মখে নিল ! ভাগ্য ভাল যে নীলু মা এখন এখানে নেই । থাকলে এই দৃশ্য দেখলে আমাকে আস্ত চিবিয়ে খেত !
-আরেকটু দে !
-বাহ ! মেহমান কে খেতে দিয়ে তুই ই সব খেয়ে নিবি !
-কে মেহমান ? আহ ! আমার মেহমান রে ...
নীলু খানিকটা হেসে ওঠে !


আমি আশ্রু চোখে হাসতে পারা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকি ! আমার প্রতি কি এক মায়া মেয়েটা অনুভব করে আমি জানি না ! কেন করে তাও জানি না ! কিন্তু মনে হয় এই মায়া টুকু ছাড়া যেন আমার জীবন টুকু অসম্পূর্ন থেকে যেত !

(সমাপ্ত)




বাস্তবে মেয়ে গুলো এমন মায়াবতী হয় না ! এমন মায়াতী মেয়ে কেবল হুমায়ুন আহমেদের বইতে পাওয়া যায়, যারা তাদের কাছের মানুষ গুলোর জন্য অদ্ভুদ মায়া মায়া অনুভব করে । সেই মায়া জন্ম এই পৃথিবীতে না ! অন্য কোথাও !
আমি সারা জীবন সেই মায়াবতী সন্ধান করে গেছি ! যাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি সেও আমার প্রতি এমন মায়া অনুভব করে কি না জানি না ! আমি জানতে চাইও না ! কেবল কল্পনা করে নিতে চাই যে, নাহ, এটা সত্য না । এমন একজন আছে আছে । অবশ্যই আছে যে আমার জন্য এমন মায়া অনুভব করে ! আমি বাইরে খেতে গেল সে জোর করে আমাকে নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে আসবে । বাবা মায়ের চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করে আমাকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে গরম ভাত খাওয়াবে ! রুই মাছের ঝোল আর ডাল ! কখন কি লাগবে সেটার জন্য আমার সামনেই বসে থাকবে ! খাওয়া শেষ হতেই সাবান আর তোয়ালে নিয়ে সামনে এসে হাজির হবে !   

ভালবাসার অনু-গল্প সমগ্রOù les histoires vivent. Découvrez maintenant