৫ টি টুকরো গল্প

1.8K 35 2
                                    

গল্প নম্বরঃ ০১


হাতে নিয়ে আরেকবার চিন্তা করলাম । মনে হল কাজটা করা ঠিক হবে না । আবার মনে হল হয়তো কিছুই হবে না । কিন্তু লোকটা যেভাবে বলল তাতে কাজ হলেও হতে পারে । আমি আস্তে করে তিনবার প্রদীপে ঘষা দিলাম ।
এক বার !
দুই বার !
তিনবার !
কিছুই হল না । দুরও । কিছুভবে এটা ভাবতেই কেমন বোকা বোকা লাগছে । ঠিক তখনই আমার ফেসবুকে একটা নক এল । আমি স্বাধারনত অপরিচিত কারো মেসেজের উত্তর দেই না । কিন্তু এই মেসেজটার উত্তর না দিয়ে পারলাম না । কারন ফেসবুক প্রোফাইলের নাম দেখাচ্ছে "জ্বীন আরাফাত" ।
আমি কিছু সময় ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম । এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এরই মধ্যে এই জ্বীন আরাফাত আমার ফ্রেন্ড লিস্টেও এড হয়ে গেছে !
কিন্তু কিভাবে ? আমি তো একে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই নি ।
আরেকবার মেসেজ !
"হুকুম করুন মালিক । আমি আপনার গোলাম । আপনার একটা ইচ্ছা পূরন করবো"
আমি মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না । এই সবের মানে কি ?
লিখলাম, "এসবের মানে কি ?"
"ফেসবুকে নক দিয়েছি বলে অবাক হচ্ছেন ?"
"তাই কি হওয়ার কথা না ?"
"আসলে সব কিছু আধুনিক হচ্ছে । আমরাই বা কিভাবে পিছিয়ে থাকি কিভাবে ? এখন ঝটপট বলে ফেলুন আপনার একটা ইচ্ছার কথা । আমার আরও কাজ আছে ?"
"তোমার না তিনটা ইচ্ছা পূরন করার কথা ?"
"আগে ছিল । এখন অফার কমিয়ে দিয়েছি । জলদি বলে ফেলেন ইচ্ছার কথা"


আমি কিছু সময় চিন্তা করলাম । তারপর বললাম, "আচ্ছা আমার ইচ্ছা হচ্ছে আমার বর্তমান এবং সামনের সম্ভব্য প্রেমিকা কিংবা বউ যেই হোক না কেন তার যেন কোন ছেলে বেস্টফ্রেন্ড না থাকে । তারা যেন এই পৃথিবী থেকেই গায়েব হয়ে যায়"
মেসেজটা পাঠিয়ে কিছু অপেক্ষা করলাম । তাকিয়ে দেখে মেসেজ সীন হয়েছে । কিন্তু তার কয়েক সেকেন্ড পরেই জ্বীন আরাফাতের নীল নাম টা কালো হয়ে গেল । আমি "কই, কি হল" লিখে মেসেজ লিখতেই ফেসবুক জানালো ইউ ক্যান্ট রিপ্লাই দিস ! জ্বীন আরাফাত আমাকে ব্লক দিয়ে চলে গেছে । পারবি না বললেই হত ব্লক দেওয়ার কি দরকার ছিল ! বেটা বদ ।

-------০০--------


গল্প নম্বরঃ ০২


-অপু এই অপু !
আরাম করে ঘুমিয়ে ছিলাম । আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল । একট পরেই অনুভব করলাম আমার শরীরে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে । কে ধাক্কা দিচ্ছে সেটা বুঝতেও আমার কষ্ট হল না !
ঘুম আমার কাছে খুবই প্রিয় । আর শীতের ঘুম হলে তো কথাই নেই । সেই ঘুম ভাঙ্গালে আমার বড় রাগ হয় । এটা ইভার জানার কথা তবুও ও আমাকে এই রাতের বেলা ডাকছে কেন ?
আমি বললাম
-কি হল ?
-ভূমিকম্প হচ্ছে !
খানিকটা সময় বোঝার চেষ্টা করলাম আসলেই ভূমিকম্প হচ্ছে কি না ! বুঝতে পারলাম যে আসলেই হচ্ছে । আমি বললাম
-হ্যা হচ্ছে ! এখন কি করবা ! ফেসবুকে স্টাটাস দিবা ?
-ইয়ার্কি ভাল লাগছে না ! আমার ভয় করছে । চল নিচে যাই !
আমি ওর দিকে পাশ ফিরলাম ! তারপর বললাম
-এখন ভূমিকম্প কেন সুনামী হলেও আমি নিচে নামবো না ! বেশি ভয় করলে তুমি নিজে চলে যাও নিচে !
ডিম লাইটের আলোতে ইভার মুখটা দেখতে পাচ্ছি । মেয়েটা সব কিছুতেই এমন ভয় পায় কেন আমি ঠিক বুঝি না ! আমি বললাম
-ভয় পেও না । এদেশে এমন ভূমিকম্প কোন দিন হবে না ! বেশি ভয় লাগলে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকো । যদি মরি দুজন এক সাথে মরবো !
আমি আর কথা বাড়ালাম না ! আবার চোখ বন্ধ করলাম । ইভা উঠে একটু নড়াচড়া করলো । এদিক ওদিক হাটা চলা করলো । তারপর যখন বুঝলো যে আমি সত্যিই নামবো না তখন বাধ্য হয়ে আবার শুয়ে পড়লো আমার পাশেই । একটু পরে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ! তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল
-যদি বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে তোমার কিন্তু খবর আছে !
আমি হাসতে হাসতে বললাম
-আচ্ছা ! যদি বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে তাহলে এবার থেকে মশারী আমার টাঙ্গাবো ! ঠিক আছে ?
-হয়েছে !
খানিকটা রাগ দেখাতে চাইলো তবে সেটা কাজ হল না । আমার সাথে ওর রাগ কাজ করে না ! তবে অনুভব করতে পারছিলাম যে ও যেন আমাকে আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে, যেন আমি সামনে থাকলেই ভূমিকম্প ওকে কিছু করতে পারবে না !
--------
টুকরো গল্পঃ ভূমিকম্প


----------০০---------


গল্প নম্বরঃ ০৩


ঢাকা শহরের লোকজন এমন যে পাশের বাসার মানুষ মরে পরে থাকলেও বাইরে বের হতে চায় না । কিন্তু যদি একবার একটু ভূমিকম্প অনুভুত হয় তাহলে যে যেমন ভাবে আছে তেমন ভাবেই নিচে দৌড় মারে । আমি অবশ্য কখনই তাড়াহুড়া করি না । কারণ আমার কেন জানি মনে হয় বড় ধরনের ভূমিকম্প কোনদিনই এখানে হবে না । আমি বেশির ভাগ সময়ই বাসাতেই থাকি । কিন্তু মায়ের জন্য সেটা পারা যায় না । পারলে আমাকে কোলে করে নিয়ে যায় ।
আজকে বিকেলে যখন পুরো ঢাকা শহর কেঁপে উঠলো তখন সবাইকে জোর করে নামিয়ে দিয়ে মা নিচে চলে গেল । আমি নামতে শুরু করেছি ধীরে ধীরে । অবশ্য চারিপাশ থেকে চিৎকার চেঁচামিচির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি ! কয়েক ধাপ নামতেই আরেকবার কেঁপে উঠলো বিল্ডিংটা !
যখন আমাদের ফ্লোর থেকে এক ফ্লোর নিচে এলাম তখন চোখ গেল সুপ্তিদের বাসার গেটের দিকে । সুপ্তির মা অসহায়ের মত মেয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । সুপ্তির গত পরশু দিন পা ভেঙ্গে গেছে রিক্সা থেকে পরে গিয়ে । ও দরজায় দাড়িয়ে মাকে বলছে, মা তুমি নিচে নেমে যাও প্লিজ ! আমার কিছু হবে না !
-আমি থাকি আমারও কিছু হবে না ! মরলে দুজন এক সাথে মরবো !
কিন্তু যখন আরেকবার বিল্ডিংটা কেঁপে উঠলো তখন সুপ্তির মা মেয়েকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন ! তিনি ওকে নিয়ে যাবেনই নিচে ! আমার কেন জানি হাসি এল খুব ! তবে সুপ্তির চেহারা দেখে খানিকটা সাহায্য করতে মন চাইলো ! আমি এগিয়ে গেলাম !
ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আন্টি আপনি নিজে যান ! আমি ওকে নিয়ে আসছি !
সুপ্তি আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার কোলে উঠবো না !
-শোনো এটা তর্ক করার সময় নয় ! আরেকবার বড় ঝাঁকি দিবে এখনই । এখন যদি না নামি তাহলে কিন্তু খবর আছে ! আর তুমি না গেলে তোমার মাও যাবে না ! এটাই তুমি চাও ?
এই কথাটাতেই কাজ হল ! সুপ্তি ওর মায়ের দিকে তাকালো ! আমি সেই সুযোগ না দিয়ে বলল
-আন্টি আপনি ওর হুইল চেয়ারটা নিন ! আমি ওকে তুলছি !
যদিও আমার মনে খানিকটা সন্দেহ ছিল যে আমি ওকে ঠিক মত তুলতে পারবো কি না ! তবে যখন ওকে কোলে নিলাম কেমন যেন হালকাই মনে হল । আসলেই এক মণ মালমাল তুলতে যে কষ্ট, এক মণ ওজনের মেয়ে কোলে নিতে সেই কষ্ট হয় না ! আমি ওকে কোলে নিয়েই সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম ! সুপ্তির মা আমার আগে আগে নামছে ! সুপ্তি আমার গলা জড়িয়ে খানিকটা সংকুচিত হয়ে আছে ! আমার অবশ্য খারাপ লাগছে না ! বরং মজাই লাগছে !
কিন্তু আসল ঘটনা ঘটলো যখন নিচে নেমে এলাম । আমাদের বাসার সিড়িটা একেবারে গেটের কাছ এসেই থেমেছে ! রাস্তা থেকেই দেখা যায় ! আমি ওকে কোলে করে নিয়েই গেটেই কাছে চলে এলাম সেখানে অনেকেই রয়েছে । বিশেষ তুহিন ভাই আমাদের এভাবে দেখে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইলো ।
আমি ওকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলাম । তাকিয়ে দেখি ওর মুখ একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ! সেই সাথে তুহিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখ একেবারে কালো হয়ে গেছে !
তুহিন ভাই আমাদের একখানে থাকে ! খুব ভাল ছাত্র ! মেয়েদের ক্রাশ, সবাই তাকে পছন্দ করে ! তিনিও অনেককে পছন্দ করেন । কয়েকটা প্রেমও করেছেন তবে ভাল ছাত্রদের এসব দোষ দেখা হয় না ! কদিন থেকেই সে সুপ্তির পেছনে লেগেছেন তবে সুপ্তি পাত্তা দিচ্ছে না । কিন্তু শোনা যাচ্ছে সেও পাত্তা দিতে শুরু করে করবে খুব জলদি ! এমন সময় এই কাহিনী !
আমি ওদের রেখে সামনে এগিয়ে এলাম । আর অবশ্য কাঁপাকাপি করলো না । সবার ভয় কেটে গেলে যে যার বাসায় ফিরে এল । তবে সুপ্তিকে যখন ওর মা লিফ্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো আমার দিকে চোখ পড়তেই আমি দেখতে পেলাম সেখানে অন্য রকম কিছু কাজ করছে।
সেটা টের পেলাম বিকেল বেলাতেই । সুপ্তির মা আমাদের বাসায় এল সুপ্তিকে নিয়ে । আমাকে ধন্যবাদ দিতে । সবাই নাকি এমনটা করে না । সবাই নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত ! সেখানে আমি ওদেরকে ছেড়ে যাই নি !
মায়ের সাথে সুপ্তির মা গল্প শুরু করে দিলে দেখলাম সুপ্তি নিজেই হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে আমার ঘরে এসে হাজির হল ! ও যে আসবে আমি জানতাম ! আমার দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাঙ্কিউ !
আমি বললাম, কেন ? তোমাকে কোলে নেওয়ার জন্য ?
সুপ্তি কোন কথা না বলে আমার টেবিলের দিকে চলে গেল ! ওখানে আমার কিছু গল্পের বই ছিল সেখান থেকে একটা নিতে নিতে বলল
-তুহিন ভাইয়া খুব বেশি জ্বালাচ্ছে ! আজকের পর আরও জ্বালানো শুরু করবে !
-রাজি হয়ে যাও ! সব দিক দিয়ে সে পার্ফেক্ট !
-আমার এতো পার্ফেক্ট লোক পছন্দ না !
-তাহলে কাকে পছন্দ ?
-সেটা শুনতে হবে না ! আমি এসেছি তোমার সাহায্য নিতে !
-কি রকম?
-আমি তুহিন ভাইকে বলেছি যে আমাদের ভেতরে কিছু চলছে ! এই জন্যই তুমি আমাকে এভাবে নিয়ে এসেছো !
-সেকি !! মিথ্যা বলেছো কেন ? আমাদের ভেতরে তো কিছু চলছে না ! শুনো আমি এসব মিথ্যার ভেতরে নাই । পরে ঝামেলা হবে ! আমি .....
আমি এক টানে এতো গুলো কথা বলতে বলতেই দেখি সুপ্তি হুইল চেয়ার টেনে আমার একেবারে সামনে চলে এসেছে ! তারপর উঠে দাড়ালো ! একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হলেও দেখলাম ও আমার সামনেই হেটে দেখালো ! তারপর আবারও চেয়ারে গিয়ে বসলো !
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি তো চলতে পারো ! ইচ্ছে করলেই সিড়ি দিয়ে নামতে পারতে !
সুপ্তি রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, হ্যা পারতাম ! কিন্তু আমার কোলে চড়ার খুব শখ ছিল যে !
-মানে কি !
সুপ্তি এবার একটু জোরে হেসে উঠলো ! তারপর হুইলচেয়ারটা দরজার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
-অপু তুমি যে গাধা, গাধাই রয়ে যাবে ! বলতে তো আর পারবা না কোনদিন ! আমি ঠিক জানতাম তখন মা বাদে আর অন্তত একটা মানুষ আমাকে না নিয়ে কিছুতেই নিচে যাবে না ! তাই তো ওমন ভাবে অপেক্ষা করছিলাম দরজার সামনে !

ভালবাসার অনু-গল্প সমগ্রWhere stories live. Discover now